স্বামীর এক টুকরো ভিটে, সেখানে আমেনা বারো বৎসরের ছেলেকে নিয়ে থাকে, দুই বৎসর হয় স্বামী পালিয়েছে, আমেনা শুনেছে স্বামী আতর আলী বিয়ে করে ঘরজামাই হয়েছে। আমেনা কিংবা ছেলে স্বপনের কোন খোঁজ-খবর নেয়না। আমেনা মাটি কামড়ে পড়ে আছে, ভিটে ছেড়ে যাচ্ছে না। দু'বেলা অন্ন জুটেনা, কিন্তু এ বাড়ি ছাড়তে রাজী নয় আমেনা। মানুষের বাড়িতে ধান মারাই। ঘর লেপ-ছেপ দিয়ে যা পায় তা দিয়েই মা-ছেলে চলে, স্বপন ডাঙগুলি নিয়ে ঘুরে সারাদিন, পান্তা-মরিচ পোড়া হোক আর ঝাল মাংসই হোক খেতে পারলেই চলে, আমেনাও তাগিদ দেয় না, নিজে না খেয়ে ছেলের জন্য রেখে দেয়। এমনিতে আর দিন যায় না, আমেনা একটি নিয়মিত কাজ খোঁজ করে পাচ্ছে না। কারো বাড়িতে সারাদিন কাজ করে যেন, যদি ছেলেকে নিয়ে দুটি খেতে পায়। কিন্তু মিলে না, কাজ মিললেও সঙ্গে ছেলে তাতে গ্রামের কেউ নিয়মিত রাখতে রাজী না। ঝুটা যা মাঝে মধ্যে মিলতো তাও আর মিলছে না। সবার মুখ গম্ভীর। মানুষ যেন হাসতেও ভুলে গেছে। আমেনা জানতে পারলো, যুদ্ধ চলছে। এবার এদেশ থেকে পাকিস্তানিদের তাড়াবে। কিন্তু কেন? পাকিস্তানীরা এদেশের সারা সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। লুট করে তাদের পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ করছে। এই পাকিস্তানীদের তাড়াতে পারলে শান্তিতে দু'মুঠো ভাত খাওয়া যাবে।
সরলমতি আমেনা আর কিছু বুঝুক না বুঝুক এটা বুঝতে পেরেছে। পাকিস্তানিদের তাড়াতে পারলে শান্তিতে দুই বেলা খেতে পারবে। ওরা সব সম্পদ লুটে নিয়ে যাচ্ছে বলেইতো আমেনা ও তার ছেলে খেতে পাচ্ছে না। প্রাণ খুলে দোয়া করছে আমেনা- তাড়াতাড়ি যেন পাকিস্তানিদের কে তাড়াতে পারে। যুদ্ধ চলছে, আমেনার কাজ একেবারে বন্ধ, অনাহারে কঙ্কালসার, স্বপন খানা না পেলে কান্নাকাটি করে, ঘরে ঘরে ভিক্ষা করে খুঁজে ছেলেকে এনে খাওয়ায়। আর বলে-শয়তান রা যায় না ক্যান ?
ওরা তো এতো সহজে যাবে না, যুদ্ধে পরাজিত করতে পারলেই না যাবে, গাঁয়ের অনেক তরুণ যুদ্ধে গেছে, ওরা যুদ্ধ করছে- আহারে স্বপনটা যদি বড় অইতো তাইলে হেরেও যুদ্ধে পাঠাইতাম। আইচ্ছা যুদ্ধে যে মানুষে যায় মানুষ খায় কি ? স্বপন প্রশ্ন করে মাকে ? না খেতে খেতে অসুখ বেঁধে গেছে, শরীর শুকিয়ে গেছে, তাই খাবারের চিন্তাটা আগে আসে।
-খায়, না জানি, না খাইয়া যুদ্ধ করবো ক্যামনে ? গায়ে বল না থাকলে কি যুদ্ধ করা যায় ?
-তাইলে আমিও যুদ্ধে যামু ।
-তরে যুদ্ধি নিবো ?
-নিবো না ক্যান ? আমি যুদ্ধ করতে পারুম না ?
-যাইতে পারলে তো ভালাই অইতো। মাইনসের মুখের দিকে চাওন যায় না, তার পরেও তোর লাইগ্যা ভিক্ষা করা লাগে।
-তাইলে আম্মা আমি আজগাই যামু।
-হ- পারলে যা, মাইনসে কয়, হেরারে খেদাইতে পারলে, খাওন, পড়নের অভাব অইতো না।
পাশের বাড়ির হামিদও যুদ্ধে যাবে শুনেছি।
আমেনা হামিদের হাতে-পায়ে ধরে স্বপনকে সঙ্গে দিয়ে দিলো। আমেনার আর কোন চিন্তা নেই। স্বপনের খাবার জোগাড় করতে আর হাত পাততে হবে না। কিন্তু শঙ্কা মুক্ত না। স্বপনের কথা ভাবলে বুকের মধ্যে কেমন যেন করে। বারো বৎসরে একদিনও স্বপনকে ছাড়া ঘুমাইনি আমেনা। রাতে ঘুম আসে না। দিন যায়, মাস যায় যুদ্ধ শেষ হয় না। হঠাৎ একদিন হামিদ রাতে বাড়ি এসেছিলো মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।
স্বপন অন্যের হাতে লেখিয়ে মাকে চিঠি দিয়েছে, হামিদের মা পড়ে শুনালো আমেনাকে।
মা,
আমি ভালো আছি।
আমার জন্য চিন্তা করো না।
সবাই যুদ্ধে যায় আমাকে নেয় না। আমি নাকি ছোট তাই। তবে সবার এটা-ওটা সেবা করি। খাবারের কোন অসুবিধা নাই। চিন্তা করো না, দেশ স্বাধীন হলে তারপর বাড়ি আসবো।
তোমার আদরের
স্বপন।
চিঠিটা একটু বুকে নিলো আমেনা, চিঠিটা নিয়ে কৌটার ভিতর রেখেদিলো।
কিন্তু আমেনার দিন আর যায় না, এদিক সেদিক থেকে মৃত্যুর খবর আসে, যুদ্ধে স্বজন হারানোর কান্না, আমেনাও মনকে মানাতে পারেছে না, সে শুধু কাঁদে, মানুষ সান্ত্বনা দেয়।
-তুই কাঁন্দস ক্যা ? তোর পোলা তো যুদ্ধ করতে যায় না ক্যাম্পে থাকে, হে মরবো কিয়ের লাইগ্যা ?
কিন্তু মায়ের মন তো এসব কথায় বুঝ মানেনা। বুকের ভিতর হুলুস্থুল ব্যথা চলে। চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রু বন্যা।
যুদ্ধ শেষ, সবাই গ্রামে ফিরে আসছে, হামিদও এসেছে, আমেনা ঘর ছেড়ে বের হচ্ছেনা, হামিদ যেহেতু এসেছে স্বপনও এসেছে। স্বপন এসেই মাকে জড়িয়ে ধরবে, ছেলের সারা গায়ে চুমু খাবে। আর কোন অশান্তি থাকবে না। পাকিস্তানিরা তো গেছে, এখন আর ভাতের অভাব হবেনা। সময় চলে যাচ্ছে। হামিদ এসেছে সেই কতক্ষণ, কিন্তু স্বপন আসছে না কেন ? আমেনার মন উতলা হচ্ছে ক্রমে, এই অনাহারী শুকনো শরীরটাও ঘামছে।
হঠাৎ আমেনার সামনে হামিদ দাঁড়িয়ে। হামিদ কে জিজ্ঞাসা করে আমেনা ?
-যুদ্ধ শেষ অইছে ?
-হামিদ আদ্র চোখে সম্মতি জানায়।
-কই, আমার বাজান কই ?
-হামিদের মুখে কোন কথা নাই।
মুক্তিযোদ্ধার চোখে পানি, টপ করে মাটিতে পড়লো, হামিদ নিজেও অনেক মিলিটারি মেরেছে, অনেক সহকর্মির লাশ দেখেছে, কিন্তু চোখে পানি আসেনি। স্বপনের জন্য বুক ফেটে যায়। ক্যাম্পের প্রতিটি যোদ্ধার কাছে ছিল একটি প্রিয় মুখ। তার সব সময় একটাই জিজ্ঞাসা ছিলো দেশটা স্বাধীন অইবো তো ? মিলিটারি সব ডরে ভাগবো তো ?
কোন যোদ্ধা আহত হলে তার পাছ ছাড়েনি স্বপন, কোন যোদ্ধ নিহত হলে চোখের জলে বুক ভিজাতো। যেন তার আপন জনের মৃত্যু হয়েছে। সেই স্বপন মরলো মিলিটারির বুলেটে।
মিলিটারিরা ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়, সবাই কোনমতে বেঁচে গেলেও আহত স্বপনকে নির্মমভাবে হত্যা করে ওরা।
হামিদের মুখের দিকে আর একবার তাকায় আমেনা, আর তাকাবার সুযোগ পায়নি অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে, জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর অন্য কোন কথা নেই মুখে। যাকে সামনে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে ?
-হেয় মিয়া যুদ্ধ শেষ অইতে আর কয়দিন লাগবো ?
যদি কেউ বলেছে।
-অগো বেডি যুদ্ধ তো শেষ।
-স্বপন আইবো কবে ?
এই প্রশ্নের জবাব কারো জানা নেই।
কেউ হয়তো বলে- আইবো আর কয়দিন বাদে, তুমি চিন্তা কইরো না।
আগুনে পোড়া ঘায়ে মলম লাগালে কতটুকু আর যন্ত্রণা কমে।
আমেনা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে, মানুষের জিজ্ঞেস করে।
-হে ও মিয়া যুদ্ধ শেষ অইবো কবে ?
একদিন আমেনা চলে গেলো স্বপনের কাছে, কিন্তু স্বপনদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ঠিকই কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়নি আজো। তার বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পরিচিত পথিক যেন শুনতে পায়। আমেনা চিৎকার করে প্রশ্ন করছে ?
হেও মিয়া যুদ্ধ শেষ অইবো কবে...?